নকশী কাঁথার আদি কথা


পল্লী কবির জসিম উদ্দিন এর নকশী কাঁথার মাঠ কবি তা নয় , কথা বলবো পল্লী শিল্পের যুগ যুগ ধরে  গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী গ্রামীন শিল্প নকশী কাঁথা নিয়ে । 

পল্লীশিল্পের কথা ভাবতেই প্রথমে মনে পড়ে যায় নকশি কাঁথার কথা। যুগ যুগ ধরে বাংলার গ্রামের নিভৃতে তৈরি হচ্ছে এই কাঁথা। বাংলাদেশের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলার মধ্যে নকশি কাঁথার স্থান রয়েছে অনেক উঁচুতে। সংস্কৃত শব্দ 'কন্থা' ও প্রাকৃত শব্দ 'কথ্থা' থেকে 'কাঁথা' শব্দের উত্‍পত্তি বলে ধারণা করা হয়। বাংলাদেশের অঞ্চলভেদে কাঁথাকে খাতা, খেতা বা কেথা, কেতা নামে ডাকা হয়। রংপুর অঞ্চলে কাঁথাকে 'দাগলা', ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুর অঞ্চলে 'গুদুরি' বলা হয়। সূচিকর্মে অলংকৃত কাঁথাকে বলা হয় নকশি কাঁথা। অনেক জায়গায় নকশি কাঁথাকে সাজের কাঁথা বা নকশি খেতাও বলা হয়ে থাকে।
নকশি কাঁথার মূল উপাদান হলো পুরাতন কাপড় ও রঙবেরঙের সুতা। পুরোনো কাপড় কয়েক ভাঁজ করে চার ধার সেলাই করে আটকানো হয়। বয়নশিল্প ও সেলাইয়ের সমান দূরত্ব আনার জন্য প্রথমে বড় বড় ফোঁড় দিয়ে টাক দিয়ে নেয়া হয়। তারপর সেলাই করা হয়। পুরোনো শাড়ির পাড় থেকে নেয়া রঙিন সুতা অথবা রঙিন ফেটি সুতা দিয়ে কাঁথার মোটিফের কাজ করা হয়। প্রথমে কেন্দ্রীয় মোটিফের কাজ হয়, তারপর চারকোণায় সমধরনের নকশা বা মোটিফ সেলাই করে অলংকরণ করা হয়। এরপর খালি অংশগুলো ছোট ছোট নকশা বা জ্যামিতিক মোটিফ দিয়ে ভরাট করা হয়। সবশেষে বাকি থাকা জমিনের অংশ সাদা সুতা দিয়ে সেলাই করা হয়। সাধারণত এই রীতিতেই কাঁথা তৈরি করা হয়ে থাকে। তবে অঞ্চলভেদে রীতিতেও ভিন্নতা দেখা যায়। নকশি কাঁথায় থাকে নানান ফোঁড়। যেমন - কাইত্যা ফোঁড়, এক ফুঁইড়া, লীক ফোঁড়, ক্রসস্টিচ, তারা ফোঁড়, কাটা ফোঁড়, বরকা ফোঁড়, তেসরী ফোঁড়, বাঁশপাতা ফোঁড়, বৈকা, বোতাম ঘর, হেরিং বোন, চেইন, কাঁথা ফোঁড়, রান ফোঁড়, ডবল রান, তেরছা ফোঁড়, বখেরা ফোঁড়, গাট ফোঁড়, তোলা ফোঁড়, কর্ষিদা ফোঁড় ইত্যাদি। কাঁথার পাড়েরও রয়েছে নানা নাম। যেমন - ধানের শিষ বা খেজুর ছড়ি, বিজে, মকী, চোখ, তাবিজ, মাছ, পিঁপড়ার সার, তাগা, মই, গোট, চিক, নোলক, শামুক, পদ্মপাইড়, লতাসিঁড়ি, শিকললতা, পাখিলতা, নয়চিড়ে, আটপাতা ফুল, জোড় কাঁকড়া, ঝাপদালান, ইলিশাপেটী, নয়নলতা, মুসুরী, চাঁদ নৌকাবিলাস ইত্যাদি। ফোঁড়ের ক্ষেত্রে যেমন রয়েছে বিভিন্ন  তেমনি অঞ্চলভেদে কাঁথার মানও হয় আলাদা। যেমন- চাঁপাইনবাবগঞ্জের নকশি কাঁথার ফোঁড়, কাঁথার পাড় ও নকশার গুণগত মান বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে ভিন্ন। এ এলাকার পাঁচ রকমের কাঁথা বেশ নামকরা - লহরী কাঁথা, সুজনী কাঁথা, লীক কাঁথা, কার্পেট কাঁথা ও ছোপটানা কাঁথা। প্রতিটি অঞ্চলের নকশি কাঁথার রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। কাঁথায় ব্যবহৃত ফোঁড়, সেলাইয়ের কৌশল ও নকশার ব্যবহারই বলে দেয় কাঁথাটি কোন অঞ্চলের বা কী মানসিকতা থেকে এই কাঁথা তৈরি করা হয়েছে। ফলে আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য নিরূপনে কাঁথা প্রত্যক্ষভাবেই সাহায্য করে। যেমন - রাজশাহী, বগুড়া ও কুষ্টিয়া অঞ্চলের নকশি কাঁথা আকারে বড় ও পুরু, সেলাই তেমন সূক্ষ্ম নয় এবং জ্যামিতিক নকশা ও ফুল, লতাপাতার নকশার ব্যবহার বেশি। অন্যদিকে যশোর, ফরিদপুর ও খুলনা অঞ্চলের কাঁথা আকারে তেমন বড় নয়, পাতলা, সেলাই সূক্ষ্ম এবং মানুষ ও পশুপাখির মোটিফ বেশি ব্যবহার করা হয়।
বাংলাদেশের প্রত্যেক অঞ্চলের নকশি কাঁথায় রয়েছে ফুল, ফল, লতাপাতা, বৃক্ষ ও জ্যামিতিক নকশার সমাহার। বেশির ভাগ কাঁথায় একটি মূল নকশা থাকে এবং এটাকে ঘিরে বাকি নকশাগুলো কখনো চারকোণায়, কখনো আটভাগে, বৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে থাকে। মূল মোটিফকে উজ্জ্বল করার জন্যই এমনটা করা হয়। বাংলাদেশের নকশি কাঁথায় যেসব মোটিফ দেখা যায় সেগুলো হলো - পদ্ম, অষ্টদল, শতদল পদ্ম, সহস্রদল পদ্ম, চক্র, চরকা, স্বস্তিকা, জীবনবৃক্ষ, কলকা, ঢেউ, পাহাড়, মাছ, নৌকা, পায়ের ছাপ, রথ, রাধাকৃষ্ণ, লক্ষ্মী, কৃষি যন্ত্রপাতি, হাতপাখা, পশুপাখি, ময়ূর, প্রসাধনী দ্রব্য, রান্নাঘরের জিনিসপত্র, পালকি, ঘোড়সওয়ার, মসজিদ, মিনার, গম্বুজ, চাঁদ, তারা, জ্যামিতিক নকশা, লতাপাতা, ফুল, কলকা, আলপনা ইত্যাদি।

আসুন জেনে নিই কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী নকশি কাঁথার নাম ও তার ব্যবহার -

লেপকাঁথা

এই কাঁথা শীতকালে লেপের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়। এটি অন্যান্য কাঁথার তুলনায় পুরু ও ভারী।

সুজনী কাঁথা

বিছানার চাদর হিসেবে এ কাঁথা ব্যবহার করা হয়। নওগাঁ, কুষ্টিয়া ও যশোর এলাকায় এই কাঁথাকে পাড়নী কাঁথা বা নাছনী কাঁথা বলে। অতিথি এলে বসার জন্যে এই কাঁথা বিছিয়ে দেয়া হয়।

আরশীলতা

আয়না ও চিরুনী জড়িয়ে রাখার জন্য ব্যবহৃত হয়।

দস্তরখান

অতিথিকে খাবার সময় বাসনের নিচে পেতে দেয়া হয়।

বর্তন ঢাকনা

অনুষ্ঠানে অভ্যাগতদের খাবার দেয়ার সময় বাসনের আচ্ছাদন বা ঢাকনা হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

নকশি থলে

বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে পান-সুপারি বহনের জন্য ব্যবহার করা হয়।

আসন কাঁথা

হিন্দুদের পূজা-অর্চনা বা বিয়ের অনুষ্ঠানে বর-কনেকে বসতে দেয়া হয় আসন হিসেবে।

চাদর কাঁথা

শীতকালে গায়ের চাদর হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

গিলাফ

কোরআন শরিফ বা অন্যান্য ধর্মীয় কিতাবের খোল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

রুমাল কাঁথা

এটি রুমাল হিসেবেই ব্যবহার করা হয়।

গাটরি বা বোচকা কাঁথা

কাপড়চোপড় বেঁধে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়।

চলুন ভিডিও মাধ্যমে দেখে আসি কিছু গ্রামীন নান্দনিক ডিজাইনের নকশী কাঁথা । 

Comments